বাল্যবিবাহ কমেনি
সর্বশেষ বাংলাদেশ
ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখনো
১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এবং দুই দশক ধরে এ হার প্রায় অপরিবর্তিত
রয়েছে। একইভাবে
৬৬ শতাংশের এক-তৃতীয়াংশ ১৯ বছর বয়স হওয়ার আগেই মা বা গর্ভবতী হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বাল্যবিবাহ ছেলে ও মেয়েদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এতে ঘটে সুন্দর শৈশবের সমাপ্তি; হরণ হয় নিজস্ব পছন্দ ও স্বাধীনতা; অনুপযোগী যৌন সম্পর্কে বাধ্য করা হয়; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিকাশের অধিকার ও সুযোগ খর্ব হয়—সব মিলে মেয়েটির মানসিক ও আবেগগত ক্ষত সৃষ্টি হয়, যা সারা জীবনের সুস্থতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) গত বছরে প্রকাশিত ‘প্রোগ্রেস ফর চিলড্রেন এচিভিং দি এমডিজিস উইথ ইকুইটি’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের পাঁচ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে। অর্থাৎ, বাল্যবিবাহের কুফল বেশি ভোগ করছে মেয়েরা।
স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, সচেতনতার অভাব, প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, কন্যাশিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, নিরাপত্তার অভাবকে বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী করা হয়েছে। বাল্যবিবাহের দীর্ঘমেয়াদি কুফল ভোগ করতে হচ্ছে নারীদের।
প্রথম আলোয় প্রকাশ, গত বছরের মে মাসে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার শিকটা গ্রামের রোখসানাকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় সে আত্মহত্যা করে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় রোখসানাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক দিন পর স্বামীর ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসে সে। পরে স্বামীকে তালাক দেয়। এরপর আবার পড়াশোনা শুরু করে। নান্দাইলদীঘি কলেজে পড়া অবস্থায় তার পরিবার আবার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ দেয়। মারা যাওয়ার সময় কলেজের রেকর্ড অনুযায়ী, রোখসানার বয়স ছিল ১৬ বছর ছয় মাস নয় দিন।
জামালপুর জেলার জামিরা গ্রামের কিশোরী শাপলার সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া শাপলার স্বামী বিদেশে থাকেন। পাত্র ভালো, আর্থিক অবস্থাও ভালো। অন্যদিকে শাপলার পিছু নিয়েছিল গ্রামের বখাটেরা। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত তাকে। চিঠি দেওয়া এবং যে ছেলেরা বিয়ের জন্য যোগ্য নয়, তারাও বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো শুরু করে। কেননা শাপলা দেখতে সুন্দর। শাপলার মা-বাবা মেয়ের বিয়ে দেওয়াকেই নিরাপদ বলে মনে করেছেন বলে প্রথম আলোকে জানান। এই শাপলাকেই বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরিবারের চাপে হয়তো সন্তান নিতে হবে। অপুষ্ট কিশোরী মা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করছে। এর পাশাপাশি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইনও আছে। ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস করা হয়েছে। এ আইন ১৯৮৪ সালে সংশোধন করা হয়। আইন অনুযায়ী, বাল্যবিবাহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ আইনে পুরুষের বিয়ের আইনসম্মত বয়স ন্যূনতম ২১ বছর এবং নারীর ন্যূনতম ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়। এ বিয়ের সঙ্গে জড়িত বর, কনের অভিভাবক, আত্মীয়, ইমামসহ সবার শাস্তির বিধান আছে। জড়িত পুরুষদের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডই হতে পারে। তবে কোনো নারীর জরিমানা হলেও জেল হবে না। বর ও কনে দুজনই নাবালক হলে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। ছেলে সাবালক ও মেয়ে নাবালক হলে ছেলের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডই হতে পারে।
এর পরও বিশ্বের মধ্যে বাল্যবিবাহ বেশি সম্পন্ন হওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম দিকেই রয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘বিশ্বে মায়েদের অবস্থা ২০১০’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর তিন মাস। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে যাঁদের ১৮ বছরের মধ্যে প্রথম বিয়ে হয়েছে, তাঁদের শতকরা হার ৬৬, যা ২০০৪ সালে ছিল ৬৮ শতাংশ। রাজশাহীতে ৪০, ঢাকায় ৩৩, সিলেটে ২৩, চট্টগ্রামে ২৮, বরিশালে ২৯ এবং খুলনায় ৩৪ শতাংশ নারী ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে মা হয়েছেন বা প্রথমবার গর্ভবতী হয়েছেন। কিশোরী মাতৃত্বের হার ২০০৪ সাল ও ২০০৭ সালের প্রতিবেদনে ৩৩ শতাংশে আটকে আছে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৩০ শতাংশ মা এবং ৪১ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
বাল্যবিবাহের কুফল: জনসংখ্যার ২৩ শতাংশই হচ্ছে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। ২০০৮ সালের ‘পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় যোগাযোগ কৌশলপত্র’ অনুযায়ী, কিশোরীদের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ এবং শিশুমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের প্রায় শতকরা ৩০ ভাগের বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে কিশোরীদের অল্প বয়সে বিয়ে জরায়ুমুখের ক্যানসারের অন্যতম কারণ। কেননা, এই মেয়েদের জরায়ুমুখের কোষ পরিপক্ব হওয়ার আগেই স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলন করতে হয়। এতে কোষগুলোতে বিভিন্ন ইনফেকশন হয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এনজিও এনজেন্ডারহেলথ বাংলাদেশের ‘প্রসবজনিত ফিস্টুলা এক করুণ অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মালেকা, আনোয়ারা, সেলিনাসহ কয়েকজন নারীর বীভৎস জীবনের কাহিনি প্রকাশ করা হয়েছে। এই নারীদের প্রায় সবাই বাল্যবিবাহ ও একাধিক সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে শুধু ফিস্টুলার কারণে অভিশপ্ত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন।
সন্তান জন্ম দেওয়া, লালন-পালন, পরিবারের দেখাশোনা—এ বিষয়গুলো কিশোরীবধূ ভালোভাবে করতে পারে না। এ জন্য দেখা দেয় নানা জটিলতা।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) যোগাযোগ ব্যবস্থাপক আরিফা এস শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ১২ বা ১৩ বছরের একটি মেয়েকে ২৭ বা আরও বেশি বয়সের একজন পুরুষ বিয়ে করছেন। স্বামীর কাছে তাঁর বউ একজন শিশু। একইভাবে শ্বশুরবাড়ির লোকজনও ভাবেন, একে তো শাসন করাই যায়। এতে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ে। আর যে কিশোরী-বউ মার খাচ্ছে, তার কথা বলার অধিকার নেই। সে ভাবে, এটাই হয়তো নিয়ম। আর এ ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সেভাবে সামাজিক প্রতিরোধও গড়ে ওঠেনি।
আরিফা এস শারমিন জানালেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে ইউনিসেফ ২০০৬ সাল থেকে কিশোরী অভিযান নামের একটি কর্মসূচি পরিচালনা করছে। বর্তমানে দেশের ৫৯টি জেলায় কর্মসূচিটি চলছে। এ পর্যন্ত এক লাখ ৩৪ হাজার কিশোর-কিশোরী এ কর্মসূচি থেকে বাল্যবিবাহের কুফলসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ‘পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যকণিকা’য় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কিশোরীদের মধ্যে প্রজননের হার প্রতি হাজারে ১২৬ জন। এ বয়সের বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যেই অপূর্ণ চাহিদার হার বেশি।
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস কে রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরিদ্র পরিবারে কন্যাসন্তানকে বাড়তি বোঝা হিসেবে মনে করা হয়। তাদের ধারণা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে অন্ততপক্ষে একজনের খাবার কম লাগবে। বেশি বয়সে মেয়ের বিয়ে হোক, তা মুরব্বিরাও চান না। রাস্তাঘাটে যৌন নির্যাতন বা বখাটেদের উৎপাতের কারণেও অভিভাবকেরা তড়িঘড়ি করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান। দেশের কিশোরীদের প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশই অপুষ্টির শিকার। বিয়ের পরই স্বামী ও অন্যরা সন্তানের মুখ দেখতে চায়। এক বা দুই বছরের মধ্যে সন্তান পেটে না এলে স্বামী যদি বংশরক্ষার জন্য আবার বিয়ে করে ফেলে, সে জন্য মেয়ের বাড়ি থেকেও সন্তান নেওয়ার জন্য মেয়েটিকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু এই অপুষ্ট মা কম ওজনের সন্তানের জন্ম দেয়। নবজাতক মারা যায়। মারা না গেলেও মা ও সন্তানের অসুখ লেগেই থাকে। চিকিৎসার খরচ, পরিবারের লোকজনের কাজ কামাই দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি শুরু হয়। এতে নেতিবাচক অবস্থা চলতেই থাকে পরিবারটিতে।’
এ ধরনের উদাহরণ আছে খুবই কম: গত বছরের আগস্ট মাসে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, অপ্রাপ্তবয়স্ক কনেকে বিয়ে করার দায়ে বর খোরশেদ আলমকে (২৮) জেলহাজতে পাঠিয়েছেন আদালত। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা তাঁর কার্যালয়ে আদালত বসিয়ে বরকে দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
এর আগে একই আদালতে অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুলছাত্রীকে বাল্যবিবাহ দেওয়ার দায়ে কনের বাবা আবু তাহের ও মা হোসনে আরা বেগমকে এক হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাশাপাশি সরকারি আদেশ অমান্য করার অপরাধে দণ্ডবিধি ১৮৮ ধারায় তাঁদের উভয়কে আরও এক হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সহযোগিতার দায়ে বরের বাবা কালা মিয়া ও ভাই জামাল হোসেনকে দুই হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে এক মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আদালতের আদেশের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জরিমানার টাকা পরিশোধ করে সাজা ভোগ থেকে রেহাই পান।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, সেনবাগ উপজেলার ডমুরুয়া ইউনিয়নের বাবুপুর-শ্রীপুর গ্রামের কালা মিয়ার ছেলে প্রবাসী খোরশেদ আলমের (২৮) সঙ্গে গত ২৩ জুলাই একই ইউনিয়নের নলুয়া গ্রামের আবু তাহেরের মেয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তাজ নেহার বেগমের (১৩) বিয়ের দিন ঠিক হয়। খবর পেয়ে ইউএনও মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা চিঠি দিয়ে বিয়ে না দেওয়ার জন্য কনের বাবা-মাকে নির্দেশ দেন। কিন্তু সরকারি আদেশ অমান্য করে গত ২৯ জুলাই বরের বাড়িতে কনেকে নিয়ে গোপনে কাবিনবিহীন বিয়ে দেওয়া হয়।
গত বছরের মে মাসে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে শ্রীঘরে যান ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার নাগারদিয়া গ্রামের এক মা। মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়ায় ইউএনও এস এম আবদুল কাদের গিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। ইউএনও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাঁকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। পরে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গত জুলাই মাসে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের হস্তক্ষেপে বাল্যবিবাহ পণ্ড হয়ে গেছে। মেয়েটির বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে বিয়ে দেবেন না বলে তার বাবা মুচলেকা দিয়েছেন। উপজেলার খলিশাউড় গ্রামের ওই মেয়ের (১১) সঙ্গে উপজেলার বিশকাকুনী ইউনিয়নের জামাইকোনা গ্রামের একটি ছেলের (১৬) বিয়ে ঠিক হয়।
গত জুলাই মাসে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ওবায়দুল ইসলাম মুদিরগাঁও গ্রামে গিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধের নির্দেশ দেন। মেয়েটির বাবা মুচলেকা দেন, মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেবেন না।
মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী, এই মেয়ের জন্ম ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি।
গত আগস্টে দিনাজপুর শহরের ঘাসিপাড়া মহল্লায় ১৪ বছর বয়সের আসিয়া খাতুনের সঙ্গে শহরের সুইহারী এলাকার মো. মোফাজ্জল হকের ছেলে আবদুস সালামের (২৭) বিয়ের অনুষ্ঠানে দিনাজপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুর রহমান পুলিশ নিয়ে হাজির হয়ে বিয়ে ভেঙে দেন। এ সময় বিয়ের কাজি আবদুর রশিদ ক্ষমা প্রার্থনা করলেও ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন। এ ছাড়া ছেলে ও মেয়ের অভিভাবকেরা সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিয়ে দেবেন না মর্মে মুচলেকা দেন।
গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তপন কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েদের শিক্ষায় বাল্য বিয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। শিক্ষার হার কম হলে বাল্য বিয়ের ঘটনা বেশি ঘটে, আবার বাল্য বিয়ের জন্যই মেয়েরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। হাওর, চর, পার্বত্য অঞ্চলে বাল্য বিয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। সরকারকে কিশোরীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। একই সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের জন্য কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে সরকার কাজ করছে, তবে আরও অনেক কিছু করার আছে বা করতে হবে।’ তিনি বলেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রচার, প্রচারণা, প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ছাড়া কোনো জায়গায় বাল্যবিবাহ হচ্ছে—খবর পেলেই তা প্রশাসনের মাধ্যমে বন্ধ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে ফলাফল এখনো ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। এ ছাড়া বেশির ভাগ বিয়েই হচ্ছে গোপনে বা সবার অগোচরে। অভিভাবকদের ধারণা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে আর কোনো দায়িত্ব নেই। এ ছাড়া ‘ভালো পাত্র’ পাওয়া গেলেও অভিভাবকেরা দেরি করতে চান না। কেননা, ভবিষ্যতে যদি আর বিয়ের জন্য এ ধরনের ছেলে না পাওয়া যায়!
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বাল্যবিবাহ ছেলে ও মেয়েদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এতে ঘটে সুন্দর শৈশবের সমাপ্তি; হরণ হয় নিজস্ব পছন্দ ও স্বাধীনতা; অনুপযোগী যৌন সম্পর্কে বাধ্য করা হয়; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিকাশের অধিকার ও সুযোগ খর্ব হয়—সব মিলে মেয়েটির মানসিক ও আবেগগত ক্ষত সৃষ্টি হয়, যা সারা জীবনের সুস্থতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) গত বছরে প্রকাশিত ‘প্রোগ্রেস ফর চিলড্রেন এচিভিং দি এমডিজিস উইথ ইকুইটি’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের পাঁচ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে। অর্থাৎ, বাল্যবিবাহের কুফল বেশি ভোগ করছে মেয়েরা।
স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, সচেতনতার অভাব, প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, কন্যাশিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, নিরাপত্তার অভাবকে বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী করা হয়েছে। বাল্যবিবাহের দীর্ঘমেয়াদি কুফল ভোগ করতে হচ্ছে নারীদের।
প্রথম আলোয় প্রকাশ, গত বছরের মে মাসে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার শিকটা গ্রামের রোখসানাকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় সে আত্মহত্যা করে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় রোখসানাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। কয়েক দিন পর স্বামীর ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসে সে। পরে স্বামীকে তালাক দেয়। এরপর আবার পড়াশোনা শুরু করে। নান্দাইলদীঘি কলেজে পড়া অবস্থায় তার পরিবার আবার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ দেয়। মারা যাওয়ার সময় কলেজের রেকর্ড অনুযায়ী, রোখসানার বয়স ছিল ১৬ বছর ছয় মাস নয় দিন।
জামালপুর জেলার জামিরা গ্রামের কিশোরী শাপলার সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। দশম শ্রেণীতে পড়ুয়া শাপলার স্বামী বিদেশে থাকেন। পাত্র ভালো, আর্থিক অবস্থাও ভালো। অন্যদিকে শাপলার পিছু নিয়েছিল গ্রামের বখাটেরা। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত তাকে। চিঠি দেওয়া এবং যে ছেলেরা বিয়ের জন্য যোগ্য নয়, তারাও বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো শুরু করে। কেননা শাপলা দেখতে সুন্দর। শাপলার মা-বাবা মেয়ের বিয়ে দেওয়াকেই নিরাপদ বলে মনে করেছেন বলে প্রথম আলোকে জানান। এই শাপলাকেই বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরিবারের চাপে হয়তো সন্তান নিতে হবে। অপুষ্ট কিশোরী মা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেবে।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করছে। এর পাশাপাশি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইনও আছে। ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস করা হয়েছে। এ আইন ১৯৮৪ সালে সংশোধন করা হয়। আইন অনুযায়ী, বাল্যবিবাহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ আইনে পুরুষের বিয়ের আইনসম্মত বয়স ন্যূনতম ২১ বছর এবং নারীর ন্যূনতম ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়। এ বিয়ের সঙ্গে জড়িত বর, কনের অভিভাবক, আত্মীয়, ইমামসহ সবার শাস্তির বিধান আছে। জড়িত পুরুষদের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডই হতে পারে। তবে কোনো নারীর জরিমানা হলেও জেল হবে না। বর ও কনে দুজনই নাবালক হলে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। ছেলে সাবালক ও মেয়ে নাবালক হলে ছেলের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডই হতে পারে।
এর পরও বিশ্বের মধ্যে বাল্যবিবাহ বেশি সম্পন্ন হওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম দিকেই রয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের ‘বিশ্বে মায়েদের অবস্থা ২০১০’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর তিন মাস। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে যাঁদের ১৮ বছরের মধ্যে প্রথম বিয়ে হয়েছে, তাঁদের শতকরা হার ৬৬, যা ২০০৪ সালে ছিল ৬৮ শতাংশ। রাজশাহীতে ৪০, ঢাকায় ৩৩, সিলেটে ২৩, চট্টগ্রামে ২৮, বরিশালে ২৯ এবং খুলনায় ৩৪ শতাংশ নারী ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে মা হয়েছেন বা প্রথমবার গর্ভবতী হয়েছেন। কিশোরী মাতৃত্বের হার ২০০৪ সাল ও ২০০৭ সালের প্রতিবেদনে ৩৩ শতাংশে আটকে আছে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৩০ শতাংশ মা এবং ৪১ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।
বাল্যবিবাহের কুফল: জনসংখ্যার ২৩ শতাংশই হচ্ছে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী। ২০০৮ সালের ‘পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় যোগাযোগ কৌশলপত্র’ অনুযায়ী, কিশোরীদের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ এবং শিশুমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের প্রায় শতকরা ৩০ ভাগের বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে কিশোরীদের অল্প বয়সে বিয়ে জরায়ুমুখের ক্যানসারের অন্যতম কারণ। কেননা, এই মেয়েদের জরায়ুমুখের কোষ পরিপক্ব হওয়ার আগেই স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলন করতে হয়। এতে কোষগুলোতে বিভিন্ন ইনফেকশন হয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এনজিও এনজেন্ডারহেলথ বাংলাদেশের ‘প্রসবজনিত ফিস্টুলা এক করুণ অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মালেকা, আনোয়ারা, সেলিনাসহ কয়েকজন নারীর বীভৎস জীবনের কাহিনি প্রকাশ করা হয়েছে। এই নারীদের প্রায় সবাই বাল্যবিবাহ ও একাধিক সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরে শুধু ফিস্টুলার কারণে অভিশপ্ত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন।
সন্তান জন্ম দেওয়া, লালন-পালন, পরিবারের দেখাশোনা—এ বিষয়গুলো কিশোরীবধূ ভালোভাবে করতে পারে না। এ জন্য দেখা দেয় নানা জটিলতা।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) যোগাযোগ ব্যবস্থাপক আরিফা এস শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ১২ বা ১৩ বছরের একটি মেয়েকে ২৭ বা আরও বেশি বয়সের একজন পুরুষ বিয়ে করছেন। স্বামীর কাছে তাঁর বউ একজন শিশু। একইভাবে শ্বশুরবাড়ির লোকজনও ভাবেন, একে তো শাসন করাই যায়। এতে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ে। আর যে কিশোরী-বউ মার খাচ্ছে, তার কথা বলার অধিকার নেই। সে ভাবে, এটাই হয়তো নিয়ম। আর এ ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সেভাবে সামাজিক প্রতিরোধও গড়ে ওঠেনি।
আরিফা এস শারমিন জানালেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে ইউনিসেফ ২০০৬ সাল থেকে কিশোরী অভিযান নামের একটি কর্মসূচি পরিচালনা করছে। বর্তমানে দেশের ৫৯টি জেলায় কর্মসূচিটি চলছে। এ পর্যন্ত এক লাখ ৩৪ হাজার কিশোর-কিশোরী এ কর্মসূচি থেকে বাল্যবিবাহের কুফলসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ‘পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যকণিকা’য় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কিশোরীদের মধ্যে প্রজননের হার প্রতি হাজারে ১২৬ জন। এ বয়সের বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যেই অপূর্ণ চাহিদার হার বেশি।
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস কে রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরিদ্র পরিবারে কন্যাসন্তানকে বাড়তি বোঝা হিসেবে মনে করা হয়। তাদের ধারণা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে অন্ততপক্ষে একজনের খাবার কম লাগবে। বেশি বয়সে মেয়ের বিয়ে হোক, তা মুরব্বিরাও চান না। রাস্তাঘাটে যৌন নির্যাতন বা বখাটেদের উৎপাতের কারণেও অভিভাবকেরা তড়িঘড়ি করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান। দেশের কিশোরীদের প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশই অপুষ্টির শিকার। বিয়ের পরই স্বামী ও অন্যরা সন্তানের মুখ দেখতে চায়। এক বা দুই বছরের মধ্যে সন্তান পেটে না এলে স্বামী যদি বংশরক্ষার জন্য আবার বিয়ে করে ফেলে, সে জন্য মেয়ের বাড়ি থেকেও সন্তান নেওয়ার জন্য মেয়েটিকে চাপ দিতে থাকে। কিন্তু এই অপুষ্ট মা কম ওজনের সন্তানের জন্ম দেয়। নবজাতক মারা যায়। মারা না গেলেও মা ও সন্তানের অসুখ লেগেই থাকে। চিকিৎসার খরচ, পরিবারের লোকজনের কাজ কামাই দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি শুরু হয়। এতে নেতিবাচক অবস্থা চলতেই থাকে পরিবারটিতে।’
এ ধরনের উদাহরণ আছে খুবই কম: গত বছরের আগস্ট মাসে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, অপ্রাপ্তবয়স্ক কনেকে বিয়ে করার দায়ে বর খোরশেদ আলমকে (২৮) জেলহাজতে পাঠিয়েছেন আদালত। নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা তাঁর কার্যালয়ে আদালত বসিয়ে বরকে দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।
এর আগে একই আদালতে অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুলছাত্রীকে বাল্যবিবাহ দেওয়ার দায়ে কনের বাবা আবু তাহের ও মা হোসনে আরা বেগমকে এক হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাশাপাশি সরকারি আদেশ অমান্য করার অপরাধে দণ্ডবিধি ১৮৮ ধারায় তাঁদের উভয়কে আরও এক হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সহযোগিতার দায়ে বরের বাবা কালা মিয়া ও ভাই জামাল হোসেনকে দুই হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে এক মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আদালতের আদেশের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জরিমানার টাকা পরিশোধ করে সাজা ভোগ থেকে রেহাই পান।
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, সেনবাগ উপজেলার ডমুরুয়া ইউনিয়নের বাবুপুর-শ্রীপুর গ্রামের কালা মিয়ার ছেলে প্রবাসী খোরশেদ আলমের (২৮) সঙ্গে গত ২৩ জুলাই একই ইউনিয়নের নলুয়া গ্রামের আবু তাহেরের মেয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তাজ নেহার বেগমের (১৩) বিয়ের দিন ঠিক হয়। খবর পেয়ে ইউএনও মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা চিঠি দিয়ে বিয়ে না দেওয়ার জন্য কনের বাবা-মাকে নির্দেশ দেন। কিন্তু সরকারি আদেশ অমান্য করে গত ২৯ জুলাই বরের বাড়িতে কনেকে নিয়ে গোপনে কাবিনবিহীন বিয়ে দেওয়া হয়।
গত বছরের মে মাসে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে শ্রীঘরে যান ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার নাগারদিয়া গ্রামের এক মা। মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়ায় ইউএনও এস এম আবদুল কাদের গিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। ইউএনও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাঁকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন। পরে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গত জুলাই মাসে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের হস্তক্ষেপে বাল্যবিবাহ পণ্ড হয়ে গেছে। মেয়েটির বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে বিয়ে দেবেন না বলে তার বাবা মুচলেকা দিয়েছেন। উপজেলার খলিশাউড় গ্রামের ওই মেয়ের (১১) সঙ্গে উপজেলার বিশকাকুনী ইউনিয়নের জামাইকোনা গ্রামের একটি ছেলের (১৬) বিয়ে ঠিক হয়।
গত জুলাই মাসে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ওবায়দুল ইসলাম মুদিরগাঁও গ্রামে গিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধের নির্দেশ দেন। মেয়েটির বাবা মুচলেকা দেন, মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেবেন না।
মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী, এই মেয়ের জন্ম ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি।
গত আগস্টে দিনাজপুর শহরের ঘাসিপাড়া মহল্লায় ১৪ বছর বয়সের আসিয়া খাতুনের সঙ্গে শহরের সুইহারী এলাকার মো. মোফাজ্জল হকের ছেলে আবদুস সালামের (২৭) বিয়ের অনুষ্ঠানে দিনাজপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুর রহমান পুলিশ নিয়ে হাজির হয়ে বিয়ে ভেঙে দেন। এ সময় বিয়ের কাজি আবদুর রশিদ ক্ষমা প্রার্থনা করলেও ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেন। এ ছাড়া ছেলে ও মেয়ের অভিভাবকেরা সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিয়ে দেবেন না মর্মে মুচলেকা দেন।
গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তপন কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েদের শিক্ষায় বাল্য বিয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। শিক্ষার হার কম হলে বাল্য বিয়ের ঘটনা বেশি ঘটে, আবার বাল্য বিয়ের জন্যই মেয়েরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। হাওর, চর, পার্বত্য অঞ্চলে বাল্য বিয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। সরকারকে কিশোরীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। একই সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের জন্য কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে সরকার কাজ করছে, তবে আরও অনেক কিছু করার আছে বা করতে হবে।’ তিনি বলেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রচার, প্রচারণা, প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। এ ছাড়া কোনো জায়গায় বাল্যবিবাহ হচ্ছে—খবর পেলেই তা প্রশাসনের মাধ্যমে বন্ধ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে ফলাফল এখনো ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। এ ছাড়া বেশির ভাগ বিয়েই হচ্ছে গোপনে বা সবার অগোচরে। অভিভাবকদের ধারণা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে আর কোনো দায়িত্ব নেই। এ ছাড়া ‘ভালো পাত্র’ পাওয়া গেলেও অভিভাবকেরা দেরি করতে চান না। কেননা, ভবিষ্যতে যদি আর বিয়ের জন্য এ ধরনের ছেলে না পাওয়া যায়!
সূত্র:
দৈনিক প্রথম-আলো,
নারীমঞ্চ
।
তারিখ:
২১-০৯-২০১১
Top 25 best sunscreen with zinc oxide and titanium dioxide - TIT
উত্তরমুছুনTop titanium legs 25 best sunscreen with zinc oxide 2019 ford ecosport titanium and titanium dioxide. babylisspro nano titanium spring curling iron Photo babylisspro nano titanium credit: TITNIA. A photo by TITNIA. © 2020 TITNIA. mens titanium rings